বাড়ি কিংবা সেতু। যে কোনো স্থাপনা নির্মাণ করতে গেলেই ডাক পড়ে সিমেন্টের।
সেই সিমেন্ট যে কতবছর আগে থেকে তৈরি হচ্ছে সেটি শুনলে অবাক হবেন। গুগল বলছে-সিমেন্ট মানুষের চেয়েও পুরোনো। যার ‘জন্ম’১২ মিলিয়ন বছর আগেই।
পৃথিবী নিজেই যখন তীব্র ভূতাত্ত্বিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল, তখন প্রাকৃতিকভাবে তৈরি হচ্ছিল সিমেন্ট। সেই প্রাকৃতিক সিমেন্টই মানুষ প্রথম ব্যবহার শুরু করেন। পরে অবশ্য মানুষ নিজেরাই তৈরি করতে শুরু করেন সিমেন্ট।
অ্যাসিরিয়ান এবং ব্যাবিলনীয়রা বন্ধন পদার্থ বা সিমেন্ট হিসাবে কাদামাটি ব্যবহার করতেন। মিশরীয়রা চুন এবং জিপসাম সিমেন্ট ব্যবহার করত। পরে মানুষ আবিষ্কার করেন-কীভাবে অন্যান্য উপবরণ মিশিয়ে সিমেন্ট তৈরি করা যায়। তারপর থেকে কৃত্রিমভাবে তৈরি সিমেন্টই মানুষের ভরসা।
বাড়ি নির্মাণে সিমেন্টের ব্যবহার:
সিমেন্ট নির্মাণের একটি প্রধান এবং মূল উপাদান। এটি কংক্রিট তৈরি করতে অ্যাগ্রিগেটস এবং জলের সঙ্গে মেশানো হয় যা যে কোনও কাঠামোর ধারাবাহিকতা বজায় রাখে, মজবুত করে এবং দীর্ঘজীবন নিশ্চিত করে। এটি কলাম, বিম, ফাউন্ডেশন, স্ল্যাব ইত্যাদির মতো স্ট্রাকচারাল এলিমেন্ট তৈরি করতে বাইন্ডার হিসাবে ব্যবহৃত হয় এবং এটি মজবুত, স্থিতিশীল করে এবং ধারাবাহিকতা বজায় রাখে।
বাড়ি নির্মাণে তিন ধরণের সিমেন্ট:
বাড়ি নির্মাণে সাধারণত তিন ধরনের সিমেন্টর ব্যবহার হয়। সেগুলো হলো অর্ডিনারি পোর্টল্যান্ড সিমেন্ট (ওপিসি), পোর্টল্যান্ড পোজোলানা সিমেন্ট (পিপিসি) ও পোর্টল্যান্ড স্ল্যাগ সিমেন্ট (পিএসসি)। এই তিন ধরনের সিমেন্টের মধ্যে সব জায়গায় ওপিসি খুঁজে পাওয়া যায়। তবে পিপিসি ও পিএসসি আরও ভালো মানের সিমেন্ট। কেননা এই সিমেন্ট যেমন মজবুত করে তেমনি স্থায়িত্বও দুর্দান্ত। এবার আরও একটু বিশদভাবে দেখা যাক কোনটা কেমন সিমেন্ট।
১.অর্ডিনারি পোর্টল্যান্ড সিমেন্ট (ওপিসি):
প্রথমে ওপিসি নিয়েই হোক আলোচনা। ওপিসি হলো নির্মাণশিল্পে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হওয়া সিমেন্ট। এই সিমেন্ট ক্লিঙ্কার, জিপসাম,চুনাপাথর, ফ্লাই অ্যাশ বা সূক্ষ্ম পাউডারের মতো অন্যান্য উপকরণ পিষে তৈরি করা হয়। এই ধরনের সিমেন্ট তার বহুমুখীতার জন্য পরিচিত এবং বিভিন্ন নির্মাণ কাজে ব্যবহৃত হয়। ভবনের ভিত্তি তৈরি, সেতু, রাস্তা কিংবা যে কোনো কাঠামোতেই এই সিমেন্ট সমান উপযোগী। এই সিমেন্ট আবার বিভিন্ন গ্রেডের আছে। যেমন ওপিসি ৩৩, ওপিসি ৪৩ এবং ওপিসি ৫৩। এই গ্রেডগুলোর একেকটির ভিন্নতা আছে।
২. পোর্টল্যান্ড পোজোলানা সিমেন্ট (পিপিসি):
পিপিসি পোর্টল্যান্ড সিমেন্ট ক্লিঙ্কার, জিপসাম এবং পোজোল্যানিক পদার্থ যেমন ফ্লাই অ্যাশ, ভলক্যানিক অ্যাশ, ক্যালসাইন্ড ক্লে বা সিলিকা ফিউমের সঙ্গে একত্রে মিশিয়ে তৈরি করা হয়। পোজোল্যানিক পদার্থ যোগ করা হয় মূলত স্থায়িত্ব, কার্যক্ষমতা এবং দীর্ঘমেয়াদী শক্তিমত্তা বৃদ্ধি করার জন্য। ওপিসির তুলনায় এই সিমেন্টের তাপ নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা প্রবল।এই ক্ষমতা এটিকে বড় কাঠামোতে ব্যবহার করার ক্ষেত্রে বেশ সুবিধাজনক করে তোলে। শুধু তাই নয়, এই সিমেন্ট কংক্রিটের কড়া রাসায়নিক প্রতিরোধ ক্ষমতা যেমন উন্নত করতে পারে আবার তেমনি ভালো কার্যক্ষমতাও প্রদান করতে পারে। এই সিমেন্ট বিশেষ করে বড় বড় প্রকল্পে ব্যবহার করা হয়, যেখানে পরিবেশগত নানা বিষয় ও দীর্ঘমেয়াদী স্থায়িত্বের কথা ভাবতে হয়।
৩. পোর্টল্যান্ড স্ল্যাগ সিমেন্ট (পিএসসি):
পিএসপি তৈরি হয় দানাদার ব্লাস্ট ফার্নেস স্ল্যাগের সঙ্গে ওপিসির ক্লিঙ্কার মিশিয়ে। এই সিমেন্টও শক্তি, স্থায়ীত্ব এবং কার্যক্ষমতার দিক দিয়ে উন্নত। এই সিমেন্টের উল্লেখযোগ্য সুবিধা হলো এটির বড় মাত্রার তাপ নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা। যেটা কংক্রিটকে সঠিকভাবে সম্পন্ন করতে দেয়। এই সিমেন্টও রাস্তা, সেতু, সরু টাওয়ার, ফুটপাথ এবং মেরিন নির্মাণের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। যেসব প্রকল্পে তাপ কমানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সেখানে ভিত্তি গড়তে এই সিমেন্ট হয় প্রথম পছন্দ। বিশেষ করে সালফেট আক্রমণ প্রতিরোধে অসাধারণ ক্ষমতা থাকায় এই সিমেন্ট উপকূলীয় পরিবেশে যে কোনো স্থাপনা তৈরিতে উপযোগী করে তোলে।
বাড়ি নির্মাণে কোন সিমেন্ট ব্যবহার করবেন?
সিমেন্ট কেনার আগে দেখতে হবে বেশ কয়েকটি বিষয়। চলুন জেনে নেওয়া যাক সেসব।
আগে গুণবিচারী, পরে দর্শনধারী:
একটা প্রবাদ আছে আগে দর্শনধারী পরে গুণবিচারী। সিমেন্টের ক্ষেত্রে পুরনো সেই প্রবাদের উল্টোটাই ভাবতে হবে। আগে গুণবিচারী, পরে দর্শনধারী। তাই সিমেন্টের গায়ে সুন্দর বস্তা দেখেই তড়িঘড়ি করে কেনা যাবে না, দেখতে হবে বস্তার ভেতরে লুকিয়ে থাকা সিমেন্টটা মানে কেমন।
প্রস্তুত তারিখ দেখুন:
ব্রান্ড বিবেচনা করেই নিশ্চয় সবাই সিমেন্ট কিনতে জান। কিন্তু সেই সিমেন্টও কেনার আগে প্রস্তুতির তারিখ নিশ্চিতভাবে পরীক্ষা করতে হবে। সিমেন্টের বস্তাটি যদি ৯০ দিনের পুরনো হয় তাহলে ভাবতে হবে কিনবেন কিনা! প্রকৌশলীর সঙ্গে আলোচনা করে নিবেন-এই সিমেন্ট ব্যবহার উপযোগ্য কিনা।
বস্তায় ছিদ্র নেই তো:
সিমেন্ট কেনার সময় যতই কাছের ব্যবসায়ী হোক, কিংবা ভালো ব্রান্ড হোক-এই সন্দেহটা মনের ভেতর পুষে রাখতে হবে সিমেন্টের বস্তার গায়ে ছিদ্র থাকতে পারে।পরিবহন, উঠানামাসহ বিভিন্ন কারণে বস্তায় ছিদ্র হতে পারে। তাই সিমেন্টের বস্তায় কোনো ছিদ্র আছে কিনা তাও নিশ্চিত হতে হবে, কেননা ছিদ্র থাকলে সিমেন্ট জমাট বেঁধে যেতে পারে। এমন সিমেন্ট ব্যবহার অনুপোযোগী।
সস্তার তিন অবস্থা:
অনেকেই কম দাম দেখে সিমেন্ট কিনেন। কিন্তু এটাও তো সত্যি-সস্তার তিন অবস্থা। তাই সঠিক সিমেন্ট বেছে নেওয়ার সময় কেবলমাত্র দামের কথা ভাববেন না। দর কষাকষি করে স্বল্পস্থায়ী সাশ্রয়ের চেষ্টা করলে ভবিষ্যতের খরচ অনেক বেশি হতে পারে।
ভালো ব্রান্ডে চোখ দিন:
সিমেন্ট ক্রয় করার সময় অবশ্যই নামি ব্রান্ডকে প্রাধান্য দিতে হবে। এক্ষেত্রে যাচাই করে ব্রান্ডের অতীত সাফল্য কি কি একবার দেখে নিতে পারেন। তারপর সেই ব্রান্ডটিকে বেছে নিতে পারেন।
ভূমিকম্প কিংবা কোনো দুর্যোগে বড় বড় দালান-কোঠা ভেঙে পড়তে দেখে অনেকেরই চোখ বুজে যায়, ভাবতে থাকেন এত বড় স্থাপনাও ধ্বংস হয়! উত্তর হলো-হয়। কেননা দেখা যাবে এই স্থাপনা নির্মাণে ভিত্তি যেমন দুর্বল ছিল, তেমনি কাঠামো গড়তেও ব্যবহার হয়েছিল মানহীন সিমেন্ট, ইট কিংবা লোহা।
তাই স্থাপনার ক্ষেত্রে শেষ কথা হলো- মজবুত বাড়ি সেটিই, যেটি দীর্ঘস্থায়ী হয়। আর কে না জানে স্থাপনাকে ‘দীর্ঘজীবি’ করে ভালো মানের সিমেন্ট। তাই সিমেন্ট বাছাইয়ে হেলাফেলাকে চূড়ান্তভাবে ‘না’ বলুন! মেনে চলুন ওপরের বিষয়গুলোকে…
Quamrul Neaj
A seasoned real estate and automotive expert. As the lead content creator for GariBari, he is passionate about helping users find their perfect home, car, or rental property through insightful articles and practical advice.
Leave a Reply